সময় এবং তারিখ

ঢাকা,বাংলাদেশ 

Welcome To My Websites

শরঈ প্রমাণপত্রের আলোকে তারাবীহের রাকা‘আত সংখ্যা:



শরঈ প্রমাণপত্রের আলোকে তারাবীহের রাকা‘আত সংখ্যা:

তারাবীহের রাকা‘আত-সংখ্যা কোনোযুগেই মতভেদ বা উচ্চবাচ্যের বিষয় ছিলো না। ইসলামের স্বর্ণযুগ তথা সাহাবাযুগ থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রতিটি যুগেই হারামাইন শরীফাইনসহ মুসলিম বিশ্বের প্রতিটি মসজিদে সর্বসম্মতভাবে ২০ রাকা‘আত করেই তারাবীহ আদায় হয়ে আসছিলো।

এ উপমহাদেশের মাটিতে কুচক্রী ইংরেজ সম্প্রদায় জগদ্দল পাথরের ন্যায় চেপে বসার পর থেকেই দৃশ্যপট বদলাতে শুরু করে। তারা মুসলমানদের গৌরবময় ঐক্য ও সম্প্রীতিকে নস্যাৎ করে দিয়ে সে সুযোগে নিজেদের খুঁটি পাকাপোক্ত করার লক্ষ্যে বেশকিছু নীল-নকশা আঁটে। সেগুলোই অন্যতম একটি হচ্ছে,  ইসলামের সোনালীযুগ থেকে সর্বসম্মত ও অবিচ্ছিন্ন কর্মধারার বিপরীতে পরিত্যক্ত, ভ্রান্ত ও বিচ্যুতিপূর্ণ, মুনকার মতকে উস্কে দিয়ে সরলমনা মুসলিমদের মাঝে স্থায়ী-বিভেদ ও অনৈক্যের দেয়াল তুলে দেয়া। এ হীন চক্রান্ত বাস্তবায়নের লক্ষ্যে তারা তাদের পদলেহনকারী কিছু লোক বাগিয়ে নিতে সক্ষম হয়। ফলশ্রুতিতে ইংরেজদের তৈরি এজেন্ডা নিয়ে আলেম নামধারী কতিপয় অপরিণামদর্শী ও বিপথগামী ব্যক্তি আদাজল খেয়ে মাঠে নামে। তারাবীহের রাকা‘আত সংখ্যা নিয়ে জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করা তাদের সেই এজেন্ডারই একটি অংশ। তাই সর্বপ্রথম এ উপমহাদেশে এক লা-মাযহাবী আলেমের কন্ঠে তারাবীহ নামায আট রাকা‘আত হওয়ার দাবি উঠে, যে-ব্যক্তি ইংরেজদের থেকে নিজ সম্প্রদায়ের নাম ‘আহলে হাদীস’ মঞ্জুর করিয়ে নিয়েছিলো।

কিন্তু আল্লাহর অশেষ কৃপা যে, তাদের মতাদর্শেরই আরেক আলেম মাওলানা গোলাম রাসূল সাহেব ১২৯০ হিজরীতে লা-মাযহাবীদের এই অলীক দাবিকে খণ্ডন করে ‘রিসালায়ে তারাবীহ’ নামে একটি পুস্তিকা প্রকাশ করেন। কিন্তু এতেও তারা ক্ষান্ত হলো না। কারণ, তাদের মূল এজেন্ডাই ছিলো মুসলমানদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টির মাধ্যমে ইসলামকে দুর্বল করা। 

বর্তমানে আমাদের দেশে লা-মাযহাবীদের দৌরাত্ম অসহনীয় পর্যায়ে পৌঁছেছে। তারা নিত্যনতুন ফিতনা সৃষ্টির মাধ্যমে সরলপ্রাণ মুসলমানদের পথভ্রষ্ট করছে, যেগুলোর মধ্যে তারাবীহ নামাযের রাকা‘আত সংখ্যা অন্যতম। তাই এ বিষয়ে সহীহ দলীলভিত্তিক আলোচনা পেশ করা হচ্ছে, যাতে সাধারণ মুসলমান তাদের প্রতারণা বুঝতে সক্ষম হয়।


২০ রাকা‘আত তারাবীহ-এর দলীলসমূহ:

নবীযুগে তারাবীহ:

(১) হযরত আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা হতে বর্ণিত:

أَنَّ رَسُولَ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ صَلَّى فِي الْمَسْجِدِ ذَاتَ لَيْلَةٍ، فَصَلَّى بِصَلَاتِهِ نَاسٌ، ثُمَّ صَلَّى مِنَ الْقَابِلَةِ، فَكَثُرَ النَّاسُ، ثُمَّ اجْتَمَعُوا مِنَ اللَّيْلَةِ الثَّالِثَةِ، أَوِ الرَّابِعَةِ فَلَمْ يَخْرُجْ إِلَيْهِمْ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ، فَلَمَّا أَصْبَحَ، قَالَ: «قَدْ رَأَيْتُ الَّذِي صَنَعْتُمْ، فَلَمْ يَمْنَعْنِي مِنَ الْخُرُوجِ إِلَيْكُمْ إِلَّا أَنِّي خَشِيتُ أَنْ تُفْرَضَ عَلَيْكُمْ»، قَالَ: وَذَلِكَ فِي رَمَضَانَ. (مسلم: الترغيب فى صلاة التراويح:1/259)

অর্থ: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম একরাতে মসজিদে তারাবীহ পড়লেন। সাহাবীগণও তার সঙ্গে নামাযে শামিল হলেন। দ্বিতীয় রাতে মুকতাদী-সংখ্যা আরও বেড়ে গেলো, এরপর তৃতীয় বা চতুর্থ রাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তারাবীহের জন্য বের হলেন না। প্রত্যুষে সবাইকে লক্ষ্য করে বললেন: আমি তোমাদের আগ্রহ ও উপস্থিতি লক্ষ্য করেছি। কিন্তু এ নামায তোমাদের উপর ফরয হয়ে যাবে, এ আশঙ্কায় আমি তোমাদের কাছে আসিনি। (সহীহ মুসলিম হা. নং ৭৬১)  

২. হযরত ইবনে আব্বাস রা. হতে বর্ণিত:

عَنِ ابْنِ عَبَّاسٍ، «أَنَّ رَسُولَ اللَّهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ كَانَ يُصَلِّي فِي رَمَضَانَ عِشْرِينَ رَكْعَةً وَالْوِتْرَ». ( المصنف لابن أبى شيبة:2/288)

অর্থ: ‘রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযান মাসে ২০ রাকা‘আত তারাবীহ ও বিতর পড়তেন।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা: ২/৩৯৪, হা. নং ৭৬৯২)

(আরও দ্রষ্টব্য: আল-মুনতাখাব মিন মুসনাদি আব্দ ইবনে হুমাইদ: পৃ. ২১৮, হা. নং ৬৫৩; আস-সুনানুল কুবরা [বাইহাক্বী]: ২/৪৯৬, হা. নং ৪৬১৫; আল-মু’জামুল কাবীর [তবারানী]:  ১১/৩১১, হা. নং ১২১০২; আল মুজামুল আওসাত [তবারানী]: ১/৪৪৪, হা. নং ৮০২; আত তামহীদ [ইবনে আব্দুল বার]: ৮/১১৫; আল ইসতিযকার: ৫/১৫৬)

পর্যালোচনা: হাদীসটির সনদে ইবরাহীম ইবনে ‘উসমান নামক একজন যঈফ রাবী থাকায় একদল মুহাদ্দিস হাদীসটিকে যঈফ বলেছেন। তবে তিনি বেশী যঈফ তথা মাতরূক বা পরিত্যাজ্য নন। (দ্রষ্টব্য: আল কামিল ইবনে আদী : ১/৩৮৯-৩৯৩২; তাহযীবুত তাহযীব : ১/১৪৪; ই’লাউস সুনান : ৭/৮২-৮৫)

উসূলে হাদীসের নির্ভরযোগ্য মূলনীতি অনুসারে যঈফ দুই প্রকার:

(১) যে যঈফ সনদে বর্ণিত রিওয়ায়াতের বক্তব্য শরী‘আতের দৃষ্টিতে আপত্তিজনক, সে ধরনের যঈফ কোনো-অবস্থাতেই আমলযোগ্য নয়। 

(২) যে যঈফ সনদের বক্তব্যের সমর্থনে শরী‘আতের অন্যান্য দলীল-প্রমাণ বিদ্যমান। মুহাক্কিক মুহাদ্দিস ও ফক্বীহগণের সিদ্ধান্ত হলো, সে রিওয়ায়াতকে ‘যঈফ’ বলা হলেও তা হবে শুধু ‘সনদ’-এর বিবেচনায় এবং নিতান্তই নিয়ম-রক্ষামূলক; কিন্তু বক্তব্য ও মর্মের বিচারে সেটি সহীহ। 

উসূলে হাদীসের উপরিউক্ত নীতির ব্যাপারে হাদীসশাস্ত্রের অনেক ইমামের অসংখ্য উদ্ধৃতির মধ্য হতে এখানে শুধু দু’টি উদ্ধৃতি পেশ করছি:

(১) ইমাম বদরুদ্দীন যারকাশী রহ. উসূলে হাদীসের নির্ভরযোগ্য গ্রন্থ ‘আন নুকাত’-এ লিখেন:

إِنَّ الْحَدِيْثَ الضَّعِيْفَ إِذَا تَلَقَّتْهُ الْأُمَّةُ بِالْقَبُوْلِ عُمِلَ بَهٖ عَلٰى الصَّحِيْحِ, حَتّٰى يَنْزِلَ مَنْزِلَةَ الْمُتَوَاتِرِ. (النكات على مقدمة ابن الصلاح:1/390) 

অর্থ: ‘যঈফ হাদীস যখন ব্যাপকভাবে উম্মাহর (মুহাদ্দিস ও ফক্বীহগণের) কাছে সমাদৃত হয়, তখন সে হাদীস অনুযায়ী আমল করা হবে, এটাই বিশুদ্ধ কথা। এমনকি তখন তা মুতাওয়াতির (বিপুল-সংখ্যক সূত্রে ধারাবাহিক বর্ণিত) হাদীসের পর্যায়ে পৌঁছে যায়।’ (আন-নুকাত আলা মুকাদ্দিমাতি ইবনিস সালাহ: ১/৩৯০)

(২) ইমাম ইবনে হাজার আসকালানী রহ. ‘আন-নুকাত আলা কিতাবি ইবনিস সালাহ’ (১/৪৯৪)-এ লিখেন:

وَ مِنْ جُمْلَةِ صِفَاتِ الْقَبُوْلِ أَنْ يَتَّفِقَ الْعُلَمَاءُ عَلَى الْعَمَلِ بِمَدْلُوْلِ الْحَدِيْثِ، فَإِنَّهٗ يُقْبَلُ حَتّٰى يَجِبَ الْعَمَلُ بِهٖ، وَ قَدْ صَرَّحَ بِذٰلِكَ جَمَاعَةٌ مِنْ أَئِمَّةِ الْأُصُوْلِ.                     (النكات على كتاب ابن الصلاح:1/494)

অর্থ: ‘কোনো হাদীস গ্রহণযোগ্য হওয়ার একটি নিদর্শন এই যে, ইমামগণ ঐ হাদীসের বক্তব্যের উপর আমল করতে একমত হওয়া। এরূপ অবস্থায় হাদীসটি গ্রহণ করা হবে এবং এর উপর আমল অপরিহার্য হবে। উসূলের অনেক ইমাম এই মূলনীতি উল্লেখ করেছেন।

(এ হাদীসের বিষয়ে আরো আলোচনা ই’লাউস সুনান: ৭/৮২-৮৪; মুহাদ্দিস হযরত হাবীবুর রহমান আযমী রহ. লিখিত ‘রাকা‘আতে তারাবীহ’: ৬৩-৬৯ এবং মাওলানা আমীন সফদর রহ. লিখিত ‘তাহকীকে মাসআলায়ে তারাবীহ’: ১/২০৫-২১৩ (মাজমূআয়ে রাসায়েল) ইত্যাদি কিতাব দ্রষ্টব্য)

অতএব, হাদীসটি ‘আভিধানিক’ যঈফ হলেও উপরিউক্ত আলোচনা দ্বারা লা-মাযহাবী বন্ধুগণের কাছেও এটি অবশ্য-পালনীয় সাব্যস্ত হতে আর কোনো বাধা রইলো না।

খিলাফতে রাশেদার যুগে তারাবীহ:

নবীযুগের বর্ণনা দ্বারা বুঝা গেলো যে, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর যুগ ওহী অবতীর্ণ হওয়া ও শরী‘আতের বিধানসমূহ বিধিবদ্ধ হওয়ার যুগ থাকায় জামা‘আতের সাথে নিয়মিত তারাবীহ নামায পড়লে এ নামাযটিও উম্মতের উপর ফরয হয়ে যাওয়ার আশংকা ছিলো। তাই হুজুর সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম নিয়মতান্ত্রিকভাবে তারাবীহের নামায জামা‘আতের সাথে আদায় করেন নি। বরং প্রত্যেককে নিজ নিজ ঘরে আদায় করে নিতে বলেছিলেন। পরবর্তীতে খুলাফায়ে রাশেদার যুগে (হযরত উমর রা.-এর তত্ত্বাবধানে) নিয়মতান্ত্রিকভাবে বিশ রাকা‘আত তারাবীহ পড়ার আমল শুরু হয়। ফলে বিশ রাকা‘আত তারাবীহ পড়া সুন্নাত হিসেবে সাব্যস্ত হয়। কেননা নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন:

فَعَلَيْكُمْ بِسُنَّتِي وَسُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِينَ الْمَهْدِيِّينَ، تَمَسَّكُوا بِهَا، وَعَضُّوا عَلَيْهَا بِالنَّوَاجِذِ

অর্থ: তোমরা আমার সুন্নাতকে এবং সুপথপ্রাপ্ত খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতকে আঁকড়ে ধরো। (সুনানে তিরমিযী হা. নং ২৬৭৬) 

অতএব, খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাতও নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর সুন্নাতের মতোই অনুসরণীয়।

২য় খলীফা হযরত উমর রা.-এর খিলাফতকাল: উমর রা. কর্তৃক নিয়মতান্ত্রিকভাবে তারাবীহের জামা‘আতের সূচনা সম্পর্কে প্রখ্যাত তাবেঈ আব্দুর রহমান আল ক্বারী রহ.-এর বর্ণনা নিম্নরূপ:

عن عبد الرحمن القارئ خَرَجْتُ مَعَ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ، فِي رَمَضَانَ إِلَى الْمَسْجِدِ، فَإِذَا النَّاسُ أَوْزَاعٌ مُتَفَرِّقُونَ  يُصَلِّي الرَّجُلُ لِنَفْسِهِ، وَيُصَلِّي الرَّجُلُ وَيُصَلِّي بِصَلاَتِهِ الرَّهْطُ. فَقَالَ عُمَرُ: وَاللهِ إِنِّي لأُرَانِي لَوْ جَمَعْتُ هؤُلاَءِ عَلَى قَارِئٍ وَاحِدٍ لَكَانَ أَمْثَلَ. فَجَمَعَهُمْ عَلَى أُبِيِّ بْنِ كَعْبٍ.
 لكان أمثل, فجمعهم على بى بن كعب, ...ألخ (مؤطامالك:442)   

অর্থ: ‘আমি রামাযান মাসে উমর রা.-এর সঙ্গে মসজিদে গিয়ে দেখলাম লোকেরা বিভিন্ন দলে বিভক্ত হয়ে তারাবীহ পড়ছেন। কেউ একা পড়ছেন, আবার কেউ দু’ চারজনকে সঙ্গে নিয়ে পড়ছেন। তখন উমর রা. বললেন : ‘এদের সকলকে যদি এক ইমামের পিছনে জামা‘আতবদ্ধ করে দেই তাহলে মনে হচ্ছে উত্তম হয়।’ এরপর তাদেরকে তিনি উবাই ইবনে কা’ব রা.-এর পিছনে জামা‘আতবদ্ধ করে দিলেন। (মুআত্তা মালেক  হা. নং ৪৪২)

এ প্রসঙ্গে ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ. (মৃ. ৪৬৩ হি.) মুআত্তা মালেকের ব্যাখ্যাগ্রন্থ ‘আত-তামহীদ’-এ বলেন:

“উমর ইবনুল খাত্তাব রা. নতুন কিছু করেন নি, তিনি তা-ই করেছেন যা স্বয়ং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম পছন্দ করতেন এবং ৩/৪ দিন আমল করেও দেখিয়েছেন। কিন্তু নিয়মিত জামা‘আতের কারণে তারাবীহের নামায উম্মতের উপর ফরয হয়ে যেতে পারে, এ আশংকায় তিনি স্থায়ীভাবে জামা‘আতের ব্যবস্থা করেন নি। উমর রা. এ বিষয়টি জানতেন। তিনি দেখলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর ইন্তেকালের পর এখন আর ফরয হওয়ার ভয় নেই (কেননা ওহীর দরজা বন্ধ হয়ে গেছে এবং শরী‘আত নির্ধারণের বিষয়টি সম্পন্ন হয়ে গেছে)। তাই তিনি নবীজি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লামের দিলের তামান্না অনুযায়ী ১৪ হিজরীতে জামা‘আতের ব্যবস্থা করে দেন। আল্লাহ তা’আলা এ মর্যাদা তার জন্যই নির্ধারণ করে রেখেছিলেন। আবূ বকর সিদ্দীক রা.-এর মনে এ চিন্তা আসেনি। যদিও সামগ্রিকভাবে তিনিই উত্তম ও অগ্রগণ্য ছিলেন।”  (আত তামহীদ : ৮/১০৮-১০৯)

১. হযরত উবাই ইবনে কা’ব রা. বলেন:

عن أبى بن كعب أن عمر بن الخطاب أمره أن يصلى بالليل فى رمضان فصلى بهم عشرين ركعة

অর্থ: উমর রা. আমাকে রামাযানের রাতে লোকদেরকে ২০ রাকা‘আত তারাবীহ পড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন।’ (মুসনাদে আহমাদ ইবনে মানীঈ, ইতহাফুল খিয়ারতিল মাহারাহ; ৩-৬৪, হা. নং ২০১৮)

২. সাহাবী হযরত সাইব ইবনে ইয়াযীদ রা.-এর বর্ণনা নিম্নরূপ:

«كُنَّا نَقُومُ فِي زَمَانِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً وَالْوِتْرِ»
 (السنن الكبرى للبيهقى:1/267-268, بيهقى:2/305)

অর্থ: ‘আমরা উমর ইবনুল খাত্তাব রা.-এর যুগে ২০ রাকা‘আত তারাবীহ এবং বিতর পড়তাম।’ (আস-সুনানুস সুগরা [বাইহাকী]: ১/২৭৮, হা. নং ৮৩৩; মা’রিফাতুস সুনানি ওয়াল আসার [বাইহাকী]: ৪/৪২, হা. নং ৫৪০৯)

৩. ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ রহ. থেকে বর্ণিত:

عَنْ يَحْيَى بْنِ سَعِيدٍ، «أَنَّ عُمَرَ بْنَ الْخَطَّابِ أَمَرَ رَجُلًا يُصَلِّي بِهِمْ عِشْرِينَ رَكْعَةً»
 (مصنف ابن أبى شيبة:2/393)

অর্থ: উমর ইবনে খাত্তাব রা. এক ব্যক্তিকে লোকদের ২০ রাকা‘আত পড়ানোর নির্দেশ দিয়েছেন।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা: ২/৩৯৩, হা. নং ৭৭৬৪) 

৪. হযরত ইয়াযীদ ইবনে রূমান রহ. থেকে বর্ণিত:

عَنْ يَزِيدَ بْنِ رُومَانَ قَالَ كَانَ النَّاسُ يَقُومُونَ فِي زَمَنِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ (فِي رَمَضَانَ) بِثَلَاثٍ وَعِشْرِينَ رَكْعَةً       (مؤطا مالك:صـ40)

উমর ইবনে খাত্তাব রা.-এর যুগে মানুষ (সাহাবায়ে কিরাম ও তাবেঈন) রামাযান মাসে সর্বমোট ২৩ রাকা‘আত আদায় করতেন’ (২৩ রাকা‘আত-এর মধ্যে ২০ রাকা‘আত তারাবীহ এবং ৩ রাকা‘আত বিতর ছিলো) । (মুআত্তা মালেক: পৃ-৪০, হা. নং ৪৪৮; আস্-সুনানুল কুবরা [বাইহাকী]: ২/৪৯৬, হা. নং ৪৬১৮)

পর্যালোচনা: উপরিউক্ত বর্ণনাগুলোর মূল-বক্তব্য মুতাওয়াতির হওয়ায় অকাট্যভাবে প্রমাণিত হওয়ার ক্ষেত্রে কোনোপ্রকার দ্বিধা-দ্বন্দ্বের অবকাশ নেই। তথাপি লা-মাযহাবী বন্ধুদের অভিযোগ হলো, এ বর্ণনাগুলো মুরসাল, আর মুরসাল হলো যঈফ। অথচ এটা প্রমাণিত যে, তাবেঈ ইমামগণের ‘মুরসাল’ বর্ণনা দলীল হিসেবে গ্রহণযোগ্য। দলীলের আলোকে পূর্বসূরী ইমামগণ এ বিষয়ে একমত ছিলেন। উপরন্তু, যদি একই বক্তব্যের উপর একাধিক মুরসাল রিওয়ায়াত থাকে, কিংবা মুরসাল বর্ণনার সমর্থনে উম্মাহর অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা বিদ্যমান থাকে, তাহলে যারা মুরসালকে যঈফ বলেছেন তারাও এটাকে সহীহ বা দলীলযোগ্য মনে করেন। এ প্রসঙ্গে অসংখ্য উদ্ধৃতির মধ্য থেকে এখানে শুধু আমাদের লা-মাযহাবী ভাইদের ‘আস্থাভাজন’ ইমাম ইবনে তাইমিয়া রহ.-এর বক্তব্যটিই উদ্ধৃত করছি:

   وَالْحَدِيثُ الْمُرْسَلُ الَّذِي لَهُ مَا يُوَافِقُهُ، أَوْ الَّذِي عَمِلَ بِهِ السَّلَفُ حُجَّةٌ بِاتِّفَاقِ الْفُقَهَاء    (إقامة الدليل على بطلان التحليل, الفتاوى الكبرى:4/179) 

অর্থ: ‘যে মুরসালের সমর্থনে অন্যকোনো বর্ণনা পাওয়া যায়, কিংবা পূর্বসূরীগণ যার উপর আমল করেছেন তা ফক্বীহগণের সর্বসম্মতিতে দলীল হিসেবে গ্রহণীয়।’ (ইকামাতুদ দলীল আলা বুতলানিত তাহলীল আল ফাতাওয়াল কুবরা: ৪/১৭৯, আরো দ্রষ্টব্য: মাজমূ‘আতুল ফাতাওয়া: ২৩/২৭১; মিনহাজুস সুন্নাতিন নাবাবিয়্যা: ৪/১১৭) 

শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ. এ প্রসঙ্গেই বলেছেন:

إِنَّهُ قَدْ ثَبَتَ أَنَّ اُبَيَّ بْنَ كَعْبٍ كَانَ يَقُوْمُ بِالنَّاسِ عِشْرِيْنَ رَكْعَةً فِيْ قِيَامِ رَمَضَانَ وَ يُوْتِرُ بِثَلَاثٍ. (مجموعة الفتاوى:23/112-113)

অর্থ: ‘এ বিষয়টি প্রমাণিত যে, উবাই ইবনে কা’ব রা. রামাযানের তারাবীহতে মুসল্লীদের নিয়ে ২০ রাকা‘আত পড়তেন এবং তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন।’ (মাজমূ‘আতুল ফাতাওয়া: ২৩/১১২-১১৩) 

২০ রাক‘আত তারাবীহ সম্পর্কে তিনি আরো বলেন:

ثَبَتَ مِنْ سُنَّةِ الْخُلَفَاءِ الرَّاشِدِيْنَ وَ عَمَلِ الْمُسْلِمِيْنَ. 

অর্থ: ‘খুলাফায়ে রাশেদীনের সুন্নাহ এবং মুসলিম জাতির সম্মিলিত আমল দ্বারা এটি প্রমাণিত।’ (প্রাগুক্ত)

৩য় খলীফা হযরত উসমান রা.-এর খিলাফতকাল: হযরত উসমান রা.-এর যুগেও তারাবীহ ২০ রাকা‘আত পড়া হতো।

হযরত সাইব ইবনে ইয়াযীদ রা. বলেন:

" كَانُوا يَقُومُونَ عَلَى عَهْدِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً " قَالَ: " وَكَانُوا يَقْرَءُونَ بِالْمَئِينِ، وَكَانُوا يَتَوَكَّئُونَ عَلَى عِصِيِّهِمْ فِي عَهْدِ عُثْمَانَ بْنِ عَفَّانَ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ مِنْ شِدَّةِ الْقِيَامِ "
 (بيهقى: عدد ركعات القيام فى رمضان 2/496 رجاله ثقات: أثار السنن)

অর্থ: উমর রা.-এর যুগে সাহাবায়ে কিরাম তারাবীহের নামায ২০ রাকা‘আত পড়তেন এবং শতাধিক আয়াতবিশিষ্ট সূরা পড়তেন। উসমান রা.-এর যুগে দীর্ঘ সময় দণ্ডায়মান থাকার কারণে তাদের অনেকে লাঠিতে ভর দিতেন।’ (সুনানে বাইহাকী: ২/৪৯৬, হা. নং ৪৬১৭)

৪র্থ খলীফা হযরত আলী রা.-এর খিলাফতকাল: চতুর্থ খলীফায়ে রাশেদ হযরত আলী রা.ও স্বীয় খিলাফতকালে তারাবীহের নামায ২০ রাকা‘আত পড়ার আদেশ দিয়েছেন।

(১) আবূ আব্দুর রহমান আস-সুলামী রহ. বলেন:

عَنْ أَبِي عَبْدِ الرَّحْمَنِ السُّلَمِيِّ، عَنْ عَلِيٍّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ قَالَ: " دَعَا الْقُرَّاءَ فِي رَمَضَانَ فَأَمَرَ مِنْهُمْ رَجُلًا يُصَلِّي بِالنَّاسِ عِشْرِينَ رَكْعَةً " قَالَ: وَكَانَ عَلِيٌّ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ يُوتِرُ بِهِمْ "    (بيهقى:2/496عدد ركات القيام فى مضان)

অর্থ: আলী রা. রামাযান মাসে ক্বারীদেরকে ডাকলেন এবং আদেশ দিলেন, তারা যেনো লোকদের নিয়ে ২০ রাকা‘আত তারাবীহ পড়েন। আর বিতর পড়াতেন স্বয়ং আলী রা.। (সুনানে বাইহাকী: ২/৪৯৬, হা. নং ৪৬২০)

(২) আবূল হাসনা রহ. থেকে বর্ণিত- 

عَنْ أَبِي الْحَسْنَاءِ , أَنَّ عَلِيًّا رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ «أَمَرَ رَجُلًا أَنْ يُصَلِّيَ بِالنَّاسِ فِي رَمَضَانَ 
عِشْرِينَ رَكْعَةً»    (مصنف ابن أبى شيبة:2.393)

অর্থ: ‘হযরত আলী রা. এক ব্যক্তিকে লোকদের নিয়ে ২০ রাকা‘আত তারাবীহ পড়ানোর নির্দেশ দিলেন।’ (মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা: ২/৩৯৩, হা. নং ৭৭৬৩) 

(৩) ইমাম হুসাইন রা. থেকে বর্ণিত: 

حَدَّثَنِيْ زَيْدُ بْنُ عَلِيٍّ عَنْ أَبِيْهِ عَنْ جَدِّهِ عَنْ عَلِيٍّ رضـ أَنَّهُ أَمَرَ الَّذِيْ يُصَلِّيْ بِالنَّاسِ صَلَاةَ الْقِيَامِ فِيْ شَهْرِ رَمَضَانَ أَنْ يُصَلِّيَ بِهِمْ عِشْرِيْنَ رَكْعَةً يُسَلِّمُ فِيْ كُلِّ رَكْعَتَيْنِ وَ يُرَاوِحَ مَا بَيْنَ كُلِّ أَرْبَعِ رَكَعَاتٍ فَيَرْجِعَ ذُو الْحَاجَةِ وَ يَتَوَضَّأَ الرَّجُلُ وَ اَنْ يُوْتِرَ بِهِمْ مِنْ آخِرِ اللَّيْلِ حِيْنَ الِانْصِرَافِ. (مسند الإمام زيدصـ139) 

অর্থ: ‘হযরত আলী রা. যে ইমামকে রামাযানে তারাবীহ পড়ানোর নির্দেশ দিয়েছিলেন, তাকে বলেছিলেন সে যেনো লোকদেরকে ২০ রাকা‘আত তারাবীহের নামায পড়ায়, প্রতি দুই রাকা‘আত অন্তর সালাম ফিরায় এবং প্রতি চার রাকা‘আতে বিরতি দেয়, যাতে কারও প্রয়োজন থাকলে তা সেরে উযূ করে নিতে পারে, এবং সবশেষে প্রত্যাবর্তনকালে বিতর পড়িয়ে দেয়।’ (মুসনাদে ইমাম যায়দ: পৃ. নং ১৩৯)

সাহাবায়ে কিরামের তা‘আমুল ও ইজমা:

(১) আ’মাশ রহ. বলেন:

عَنْ أَعْمَشُ قَالَ: «كَانَ (ابن مسعود رضـ) يُصَلِّي عِشْرِينَ رَكْعَةً، وَ يُوتِرُ بِثَلَاثٍ» (مروزى قيام الليل: صـ157)

আব্দুল্লাহ ইবনে মাসঊদ রা. ২০ রাকা‘আত তারাবীহ এবং তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন। (কিয়ামুল লাইল: পৃ. ১৫৭) 

(২) মোল্লা আলী আল-ক্বারী রহ. বলেন:

أَجْمَعَ الصَّحَابَةُ عَلَى أَنَّ التَّرَاوِيحَ عِشْرُونَ رَكْعَةً. (مرقات:3/194)

‘সাহাবায়ে কিরাম রা. তারাবীহের নামায ২০ রাকা‘আত হওয়ার উপর ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন।’ (মিরকাত: ৩/১৯৪)

(৩) ফিক্বহে হানাফীর নির্ভরযোগ্য কিতাব ‘আল-ইখতিয়ার লি তা’লীলিল মুখতার’-এ হযরত ইমাম আবূ ইউসুফ রহ. বর্ণনা করেন:

وَرَوَى أَسَدُ بْنُ عَمْرٍو عَنْ أَبِي يُوسُفَ قَالَ: سَأَلْتُ أَبَا حَنِيفَةَ عَنِ التَّرَاوِيحِ وَمَا فَعَلَهُ عُمَرُ؟ فَقَالَ: التَّرَاوِيحُ سُنَّةٌ مُؤَكَّدَةٌ وَلَمْ يَتَخَرَّصْهُ عُمَرُ مِنْ تِلْقَاءِ نَفْسِهِ وَلَمْ يَكُنْ فِيهِ مُبْتَدِعًا، وَلَمْ يَأْمُرْ بِهِ إِلَّا عَنْ أَصْلٍ لَدَيْهِ وَعَهْدٍ مِنْ رَسُولِ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ -، وَلَقَدْ سَنَّ عُمَرُ هَذَا وَجَمَعَ النَّاسَ عَلَى أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ فَصَلَّاهَا جَمَاعَةً وَ الصَّحَابَةُ مُتَوَافِرُونَ: مِنْهُمْ عُثْمَانُ وَ عَلِيٌّ وَ ابْنُ مَسْعُودٍ وَ الْعَبَّاسُ وَ ابْنُهُ وَ طَلْحَةُ وَ الزُّبَيْرُ وَ مُعَاذٌ وَأُبَيٌّ وَ غَيْرُهُمْ مِنَ الْمُهَاجِرِينَ وَ الْأَنْصَارِ، وَ مَا رَدَّ عَلَيْهِ وَاحِدٌ مِنْهُمُ، بَلْ سَاعَدُوهُ وَ وَافَقُوهُ وَ أَمَرُوا بِذَلِكَ. (الاختيار لتعليل المختار: للأمام أبى الفضل مجد الدين الموصلى 1/70)

অর্থ: ‘আমি ইমাম আবূ হানীফা রহ.কে তারাবীহ এবং এ বিষয়ে উমর রা.-এর কর্মপদ্ধতি সম্পর্কে প্রশ্ন করি। তিনি এর উত্তরে বলেছেন: তারাবীহ সুন্নাতে মুয়াক্কাদাহ এবং উমর রা. তা নিজের পক্ষ থেকে অনুমান করে নির্ধারণ করেননি। তিনি এক্ষেত্রে নতুন কিছু আবিষ্কারও করেননি। তিনি দলীলের ভিত্তিতে এবং রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম থেকে প্রাপ্ত নির্দেশনার ভিত্তিতেই এ আদেশ দান করেছেন। তাছাড়া, যখন উমর রা. এ নিয়ম চালু করেন এবং উবাই ইবনে কা’ব রা.-এর ইমামতিতে সকল মানুষকে একত্র করে দেন, (যদ্দরুন সবাই এ নামাযটি জামা‘আতের সাথে আদায় করতে থাকেন) তখন সাহাবায়ে কিরামের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। যাদের মধ্যে উসমান, আলী, ইবনে মাসঊদ, আব্বাস, ইবনে আব্বাস, তালহা, যুবায়ের, মু‘আজ ও উবাই রা. প্রমুখ বড় বড় মুহাজির ও আনসার সাহাবী বিদ্যমান ছিলেন। তাদের কেউই এ বিষয়টিকে প্রত্যাখ্যান করেননি। বরং সবাই তাকে সমর্থন যুগিয়েছেন, তার সাথে একমত হয়েছেন এবং অন্যদেরকেও এ আদেশ করেছেন।’ (আল ইখতিয়ার লি তা’লীলিল মুখতার [ইমাম আবূল ফযল মাজদুদ্দীন আল মাওসিলী]: ১৭০)

(৪) ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ. ‘আল ইসতিযকার’ গ্রন্থে উল্লেখ করেন:
وَهُوَ الصَّحِيحُ عَنْ أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ مِنْ غَيْرِ خِلَافٍ مِنَ الصَّحَابَةِ. (الاستذكار:5/157)

 ‘এটি উবাই ইবনে কা’ব রা. থেকে বিশুদ্ধরূপে প্রমাণিত এবং এতে সাহাবীগণের কোনো ভিন্নমত নেই।’ (আল ইসতিযকার: ৫/১৫৭) 

(৫) ইমাম ইবনে কুদামা মাকদেসী রহ. বলেন:

مَا فَعَلَهُ عُمَرُ، وَ أَجْمَعَ عَلَيْهِ الصَّحَابَةُ فِي عَصْرِهِ أَوْلَى بِالِاتِّبَاعِ. (المغنى: 2/604)

উমর রা. যা করেছেন এবং তার খিলাফতকালে অন্যান্য সাহাবীগণ যে বিষয়ে একমত হয়েছেন, তা-ই অনুসরণের অধিক উপযুক্ত।’

(আল মুগনী: ২/৬০৪, আরও দ্রষ্টব্য: কিয়ামুল লাইল: পৃ.৯১ ও ১৫৮, কিতাবুল আসার {ইমাম আবূ ইউসুফ রহ.} পৃ.৪১; বাইহাকী: ২/৪৬৬; ইবনে আবী শাইবা: ২/৩৯৩; ফাতাওয়া কাযীখান: পৃ.১১০; তাহযীবুল কামাল: ১৩/৫৯) 

আইম্মায়ে সালাফের ইজমা:

(১) শাইখুল ইসলাম ইবনে তাইমিয়া রহ.-এর ভাষায়:

إِنَّهُ قَدْ ثَبَتَ ..... فَرَأَى كَثِيْرٌ مِنَ الْعُلَمَاءِ أَنَّ ذٰلِكَ هُوَ السُّنَّةُ، لِأَنَّهُ أَقَامَهُ بَيْنَ الْمُهَاجِرِيْنَ وَ الْأَنْصَارِ وَ لَمْ يُنْكِرْهُ مُنْكِرٌ.    (مجموعة الفتاوى:23/112-113)

অর্থ: ‘এটা প্রমানিত যে, উবাই ইবনে কা’ব রা. রামাযানের তারাবীহে লোকদের নিয়ে ২০ রাকা‘আত পড়তেন এবং তিন রাকা‘আত বিতর পড়তেন। তাই বহু আলেমের সিদ্ধান্ত, এটিই সুন্নাত। কেননা, উবাই ইবনে কা’ব রা. মুহাজির ও আনসার সাহাবীগণের উপস্থিতিতেই ২০ রাকা‘আত পড়িয়েছেন এবং কেউ তাতে আপত্তি করেননি।’ (মাজমূ‘আতুল ফাতাওয়া: ২৩/১১২-১১৩)

(২) ইমাম যাবীদী রহ. বলেন:
 
وَ بِالْإِجْمَاعِ الَّذِيْ وَقَعَ فِيْ زَمَنِ عُمَرَ رضـ أَخَذَ أَبُوْ حَنِيْفَةَ  وَ النَّوَوِيُّ وَ الشَّافِعِيُّ وَ الْجُمْهُوْرُ وَ اخْتَارَه ابْنُ عَبْدِ الْبَرِّ. (إتحاف سادة المتقين:3/422)

অর্থ: উমর রা.-এর যুগে প্রতিষ্ঠিত ঐক্যমত্যকেই অবলম্বন করেছেন ইমাম আবূ হানীফা, নববী, শাফিঈ এবং সকল ইমামগণ। (ইতহাফুস সাদাতিল মুত্তাক্বীন: ৩/৪২২)

(৩) ইমাম আবূ বকর কাসানী রহ. বলেন:

(بدائع الصنائع:1/644) وَالصَّحِيحُ قَوْلُ الْعَامَّةِ لِمَا رُوِيَ أَنَّ عُمَرَ - رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ - جَمَعَ أَصْحَابَ رَسُولِ اللَّهِ - صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ - فِي شَهْرِ رَمَضَانَ عَلَى أُبَيِّ بْنِ كَعْبٍ فَصَلَّى بِهِمْ فِي كُلِّ لَيْلَةٍ عِشْرِينَ رَكْعَةً، وَلَمْ يُنْكِرْ أَحَدٌ عَلَيْهِ فَيَكُونُ إجْمَاعًا مِنْهُمْ عَلَى ذَلِكَ. (بدائع الصنائع:1/644)

অর্থ: ‘অধিকাংশ উলামায়ে কিরামের বক্তব্যই সঠিক। কেননা হযরত উমর রা. রামাযান মাসে সাহাবায়ে কিরামকে উবাই ইবনে কা’ব রা.-এর ইমামতিতে একত্র করেন এবং উবাই ইবনে কা’ব রা. তাদেরকে নিয়ে প্রতিরাতে ২০ রাকা‘আতই পড়তেন। কোনো সাহাবী এ বিষয়ে আপত্তি উত্থাপন করেননি। সুতরাং এটা তাদের ইজমাকে প্রমাণ করে।’  (বাদায়েউস সানায়ে: ১/৬৪৪, আরও দ্রষ্টব্য: বিদায়াতুল মুজতাহিদ: ১/১৫২; মুগনী: ১/৮০৩, আওজাযুল মাসালিক: পৃ. ৩৯০; আত তা’লীকুল মুমাজ্জাদ: পৃ. নং ৫৩; শরহে নুক্বায়াহ: পৃ. নং ১০৪; আউনুল বারী: ২/৩০৭; আল আযকার: ৪/৪০১; ফাতহুল ক্বাদীর: ১/৪০৭; আল বাহরুর রাইক্ব: ২/৬৬; বাদাইয়ুস সানায়ে’: ১/২৮৮; শরহে মুনিয়া: পৃ. নং ৩৮৮; মারাকিল ফালাহ: পৃ. নং ৮১)

প্রসঙ্গক্রমে এটা সুস্পষ্ট যে, ইমাম মালেক রহ.-এর নিকট তারাবীহের নামায মোট ৩৬ রাকা‘আত হলেও তিনি ২০ রাকা‘আতের কম তথা ৮ রাকা‘আত না হওয়ার দিক দিয়ে সমস্ত ইমামের প্রতিষ্ঠিত ঐক্যমত্যের উপর রয়েছেন। তবে উক্ত মাযহাবের শীর্ষস্থানীয় কিছু মুহাদ্দিস যথা, ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ. প্রমুখ-এর মতে, ২০ রাকা‘আতই শ্রেয়।

অতএব, উপরিউক্ত অকাট্য দলীলসমূহ দ্বারা তারাবীহের নামায ২০ রাকা‘আত হওয়া; ৮ রাকা‘আত না হওয়া সুস্পষ্টরূপে প্রমাণিত হলো। কাজেই এ নিয়ে আর কোনো সন্দেহের অবকাশ রইলো না।

(বিশ রাকা‘আতের জন্য আরো দেখুন: মুসান্নাফে ইবনে আবী শাইবা হা.নং ৭৬৮৪, ৭৬৮৮, ৭৬৮৬, ৭৬৮৩, সুনানে বাইহাকী কুবরা হা. নং ৪৩৯৫, ৪৯০৩)

নাসিরুদ্দীন আলবানী সাহেবের কাণ্ড:

ভারতবর্ষে তারাবীহ নামায ৮ রাকা‘আত বিষয়ক বিদ‘আত মাথাচাড়া দিয়ে উঠার পর আরববিশ্বে শায়খ নসীব রেফায়ী নামে জনৈক আলেম সর্বপ্রথম এ বিদ‘আতকে দালীলিক অবয়ব দেয়ার ব্যর্থ-চেষ্টা করেন। কিন্তু তৎকালীন আলেমগণ জোরালোভাবে তা খণ্ডন করে বই-পুস্তক রচনা করেন। এতে জনাব আলবানী সাহেবের আঁতে ঘা লেগে যাওয়ায় তিনি রেফায়ী সাহেবের সমর্থনে ১৩৭৭ হিজরীতে ‘তাসদীদুল ইসাবাহ’ নামে একটি পাল্টা-জবাবমূলক পুস্তক রচনা করেন। বইটি তার ভ্রান্তি-বিচ্যুতি এবং মুসলিম উম্মাহ ও ইমামগণের প্রতি প্রকাশ্য বিদ্রোহ ও বিদ্বেষের জ্বলন্ত উদাহরণ হয়ে রয়েছে। এছাড়া বইটিতে উসূলে হাদীস, উসূলে ফিক্বাহ ও জারহ-তা’দীল বিষয়ে তার লজ্জাজনক দৈন্য ও অপরিপক্কতার চূড়ান্ত বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। এতদসত্ত্বেও আমাদের দেশের লা-মাযহাবী বন্ধুগণ তারাবীহ বিষয়ে কলুষিত এই বইটিকেই অন্ধের ন্যায় মাথায় তুলে রেখেছেন।

এক্ষেত্রে লক্ষণীয় বিষয়টি হলো, শায়খ নসীব রেফায়ীর মতবাদের খণ্ডনে লিখিত সাড়া জাগানো কিতাব الصابة فى الانتصار للخلفاء الراشدة (আল ইসাবাহ ফিল ইনতিসার লিল খুলাফাইর রাশিদাহ)-এর ৬১নং পৃষ্ঠায় পরিষ্কার লিখা হয়েছে:

"وَلَمْ يَشُذَّ أَحَدٌ مَنْهُمْ بِمَنْعِهَا غَيْرُ هٰذِهِ الشِّرْذِمَةِ الَّتِيْ ظَهَرَتْ فِيْ زَمَانِنَا كَالشَّيْخِ نَاصِرٍ وَ إِخْوَانِهِ." 

অর্থ: “আমাদের এ যুগে গজিয়ে উঠা জনাব নাসিরুদ্দীন আলবানী ও তার সমমনা ক্ষুদ্র একটি গোষ্ঠি ব্যতীত কেউই ২০ রাকা‘আত তারাবীহকে অস্বীকার করে ভ্রান্তি ও বিচ্যুতিতে নিপতিত হয়নি।”

আশ্চর্যজনক হলো: এর জবাবে আলবানী সাহেবের পক্ষে কোনো সাহাবী, তাবেঈ, ফক্বীহ ইমাম বা কোনো মুহাদ্দিস ইমামের উদ্ধৃতি তো দূরের কথা, তিনি কোনো মসজিদের সন্ধান দিতেও সক্ষম হননি; যেখানে তারাবীহের নামায আট রাকা‘আত হতো। অনেক ঘাটাঘাটির পরও কোনো গত্যন্তর না পেয়ে অবশেষে তিনি জুরী নামক অজ্ঞাত এক ব্যক্তির উদ্ধৃতিতে প্রকাশ্য দিবালোককে অস্বীকার করার ন্যায় ইমাম মালেক রহ. সম্পর্কে বলে দিলেন যে, তিনি না-কি ২০ রাকা‘আত পড়তে নিষেধ করেছেন। অথচ শাফিঈ মাযহাবের অনুসারী উক্ত জুরী ইমাম মালেক রহ.-এর অনেক পরবর্তী একজন লোক। তার কোনো পরিচয় কিংবা ইমাম মালেক রহ. পর্যন্ত তার কোনো সনদ, বা সংশ্লিষ্টতা কোনোকিছুই খুঁজে পাওয়া যায় না। 

উপরন্তু মালেকী মাযহাবের মৌলিক গ্রন্থ এবং তদীয় ছাত্রবৃন্দ কর্তৃক সংকলিত ‘আল মুদাওয়ানাতুল কুবরা’তে সুস্পষ্ট উল্লেখ রয়েছে:

‘তারাবীহের নামায বিতরের তিন রাকা‘আতসহ মোট ৩৯ রাকা‘আত এবং তৎকালীন মদীনার গভর্নর রাকা‘আত সংখ্যা কমাতে চাইলে তিনি তাকে বারণ করে দেন।’ (আল মুদাওয়ানাতুল কুবরা: ১/১৯৩, আরও দ্রষ্টব্য: বিদায়াতুল মুজতাহিদ: ১/২৪৬, আল ইসতিযকার: ৫/১৫৭, আল মুনতাকা: ১/২০৮)

* বিশেষ দ্রষ্টব্য: তারাবীহ নামাযের রাকা‘আত সংখ্যা নিয়ে বর্তমান শতাব্দিতে উপমহাদেশের শ্রেষ্ঠ মুহাদ্দিস মাওলানা হাবীবুর রহমান আযমী রহ. ‘রাকা‘আতে তারাবীহ’ নামক বস্তুনিষ্ঠ ও গবেষণাধর্মী একটি গ্রন্থ রচনা করেছেন। বইটি ১৩৭৭ হিজরীতে প্রথম প্রকাশিত হয়। বইটিতে তিনি সাহাবা-যুগ থেকে নিয়ে লা-মাযহাবী কর্তৃক ৮ রাকা‘আতের বিদ‘আত চালু হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত দীর্ঘ সাড়ে বারোশত বছরের প্রতিটি শতাব্দির আ’মালে মুতাওয়ারাস তথা উম্মাহর সম্মিলিত অবিচ্ছিন্ন কর্মধারা এক এক শতাব্দি ধরে ধরে সবিস্তারে উল্লেখ করেছেন। তারপর অর্ধ শতাব্দি অতিবাহিত হয়ে গেলেও লা-মাযহাবীদের কেউ অদ্যাবধি তা খণ্ডন করতে সক্ষম হয়নি এবং আদৌ তা সম্ভবও নয়।

লা-মাযহাবী বন্ধুগণ কর্তৃক দলীলের মোড়কে কিছু অলীক দাবি ও সেগুলোর অসারতা:

(১) উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা রা.-এর একটি বর্ণনা:

عَنْ أَبِي سَلَمَةَ بْنِ عَبْدِ الرَّحْمَنِ، أَنَّهُ سَأَلَ عَائِشَةَ، كَيْفَ كَانَتْ صَلَاةُ رَسُولِ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي رَمَضَانَ؟ قَالَتْ: مَا كَانَ رَسُولُ اللهِ صَلَّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ يَزِيدُ فِي رَمَضَانَ، وَلَا فِي غَيْرِهِ عَلَى إِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً...الخ(صحيح مسلم:1/254)

অর্থ: ‘আবূ সালামাহ বলেন যে, তিনি উম্মুল মু’মিনীন আয়িশা রা.-কে জিজ্ঞাসা করেছেন, রামাযান মাসে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-এর নামায কেমন হতো? আয়িশা রা. উত্তরে বলেন: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রামাযান মাসে ও অন্যমাসে এগারো রাকা‘আতের বেশি পড়তেন না।’ (সহীহ মুসলিম: ১/২৫৪, হা. নং ৭৩৮০; সহীহ বুখারী হা. নং ২০১৩)

পর্যালোচনা: পাঠক-মাত্রই বুঝতে পারছেন, এটি তারাবীহ বিষয়ক কোনো হাদীস নয়। কারণ:

ক) তারাবীহ শুধু রামাযানে আদায় করা হয়, আর তাহাজ্জুদ সারা বৎসর পড়া হয়। আর হাদীসটি সারা বৎসরের আমলের বর্ণনা। অতএব, এটি হলো তাহাজ্জুদ ও বিতর-এর নামায (ফাতাওয়ায়ে উলামায়ে হাদীস: ২/৩৩০)

খ) সাহাবাগণ আমলে-নববী ও হাদীসে-নববীর মর্ম সম্পর্কে সর্বাধিক অবগত হওয়া সত্ত্বেও তারা কেউই এটিকে তারাবীহের ক্ষেত্রে প্রয়োগ করেননি। 

গ) স্বয়ং রাবী হযরত আয়িশা রা. চার খলীফার কোনো এক খলীফার যুগেও তার এ হাদীসটিকে তারাবীহের ২০ রাকা‘আতের সর্বসম্মত আমলের বিরুদ্ধে দলীল হিসেবে দাঁড় করাননি।

উপায়ান্তর না দেখে লা-মাযহাবী বন্ধুগণ তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ একই নামায হওয়ার দাবি করে বসলেন, যা সাময়িক হাসির খোরাক যোগানো ছাড়া আর কোনো কাজে আসলো না। তথাপি এখানে এদের দাবীর কিছু অসাড়তা তুলে ধরা হচ্ছে:

ক) শরী‘আতের দলীল চতুষ্টয়ের কোনো একটি দ্বারাও তারা তারাবীহ ও তাহাজ্জুদ এক ও অভিন্ন প্রমাণ করতে পারেনি এবং পারবেও না।

খ) সমস্ত মুহাদ্দিস ও ফক্বীহ ইমামগণ নিজ নিজ কিতাবে তারাবীহ ও তাহাজ্জুদের ভিন্ন ভিন্ন অধ্যায় কায়েম করেছেন।

গ) রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম কোথায় বলেছেন যে, একই নামাযের নাম এগারো মাসব্যাপী তাহাজ্জুদ, আর বারোতম মাসে সেটি তারাবীহ? 

উল্লিখিত হাদীস-কেন্দ্রিক লা-মাযহাবী ভাইদের স্ববিরোধী কিছু কার্যকলাপ দেখুন:

ক) তারা এ হাদীসটি দ্বারা ৮ রাকা‘আত তারাবীহ দাবি করলেও ঐ হাদীসেই উল্লিখিত তিন রাকা‘আত বিতর গ্রহণ করতে নারাজ।

খ) হাদীসে সারা বৎসরের কথা বলা হলেও রামাযানের বাহিরে তাদের এ আমলটি দেখা যায় না।

গ) হাদীসে উক্ত আট রাকা‘আত নামায ঘরে আদায় করার কথা বলা হয়েছে। কিন্তু তারা এটি মসজিদে গিয়ে পড়েন।

ঘ) হাদীসে এ নামায জামা‘আত ব্যতীত একাকী আদায় করার কথা থাকলেও তারা জামা‘আতের সাথে পড়েন।

(২) দ্বিতীয় দলীল হিসেবে তারা হযরত জাবের রা.-এর সূত্রে একটি বর্ণনা পেশ করে থাকেন। আর সেটি হচ্ছে:

عَنْ جَابِرٍ رَضِيَ اللَّهُ عَنْهُ قَالَ: صَلَّى رَسُولُ اللَّهِ صَلَّى اللَّهُ عَلَيْهِ وَسَلَّمَ فِي رَمَضَانَ لَيْلَةً ثَمَانِ رَكَعَاتٍ وَالْوِتْرَ. .. 

অর্থ: ‘রামাযানের একরাতে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমাদের নিয়ে আট রাকা‘আত এবং বিতর পড়লেন।’ (কিয়ামুল লাইল মারওয়াযী: ১/২১৭)

পর্যালোচনা: 
(ক) হাদীসটির একজন রাবী হলেন ইয়াকুব ইবনে আব্দুল্লাহ। আল্লামা ইবনে কাসীর রহ. তার বর্ণিত একটি হাদীস সম্পর্কে লিখেন:

وَهَذَا الْحَدِيثُ مُنْكَرٌ جِدًّا وَفِي إِسْنَادِهِ ضَعْفٌ، وَيَعْقُوبُ هَذَا هُوَ الْقُمِّيُّ وفيه تشيع، وَمِثْلُ هَذَا لَا يُقْبَلُ تَفَرُّدُهُ بِه. (البداية والنهاية:8/375)

অর্থ: ‘হাদীসটি চরম পর্যায়ের মুনকার এবং এর সনদ যঈফ। ইয়াকুব হলো শী‘আ মতাদর্শের লোক, আর এ ধরনের বিষয়ে তার তাফাররুদ (নিঃসঙ্গতা) অগ্রহণযোগ্য।’ 

তারাবীহ সংক্রান্ত এ রিওয়ায়াতটিতেও তিনি মুতাফাররিদ। তার রিওয়ায়াতটি উম্মতের ইজমা পরিপন্থী।

(খ) আরেক রাবী ঈসা ইবনে জারিয়া একজন যঈফ রাবী। তার সম্পর্কে ইয়াহইয়া ইবনে মাঈন রহ. বলেন, ‘সে কিছুই না’, নাসাঈ ও আবূ দাউদ রহ. তাকে ‘মুনকারুল হাদীস’ বলেছেন, আল্লামা সাজী ও উকাইলী রহ. তাকে যঈফ বলেছেন। ইবনে আদী বলেন, তার ‘হাদীসগুলো অরক্ষিত’। (তাহযীবুল কামাল: ২২/৫৮৮) 

অতএব, হাদীস বিশারদ ইমামগণের এসব উক্তি দ্বারা প্রমাণিত হয় যে, ঈসা ইবনে জারিয়া একজন যঈফ রাবী। ফলে তার সূত্রে বর্ণিত উক্ত রিওয়ায়াতটি কখনোই গ্রহণযোগ্য হতে পারে না।

(গ) ইমাম ইবনে আদী রহ. উপরিউক্ত হাদীসটিকে ‘গাইরে মাহফূয’ সাব্যস্ত করেছেন। ইবনে আদী-এর ভাষায় ‘গাইরে মাহফূয’ খেতাবটি মুনকার বা বাতিল রিওয়ায়াতের ব্যাপারে ব্যবহৃত হয়। মুনকার হচ্ছে যঈফ হাদীসেরই একটি প্রকার। তবে তা এতোই যঈফ যে, এর দ্বারা প্রমাণ গ্রহণ বৈধ নয়। (দেখুন! তাহযীবুল কামাল: ১৪/৫৩৩-৫৩৪; আল কামিল {ইবনে আদী}: ৬/৪৩৬; আয যুয়াফাউল কাবীর {উকাইল}: ৩/৩৮৩; ইতহাফুল মাহারাহ বিআতরাফিল আশারাহ {ইবনে হাজার}: ৩/৩০৯)

ঘ) হাদীসটি সহীহ ধরে নিলে হযরত জাবের রা.ই সর্বপ্রথম ২০ রাকা‘আতের বিপক্ষে হাদীসটি পেশ করতেন। অথচ তিনি এমনটি করেননি।

(৩) তারা তৃতীয় দলীল হিসেবে উবাই ইবনে কা’ব রা.-এর সূত্র দিয়ে একটি বিকৃত বিবরণ পেশ করে থাকেন। রিওয়ায়াতটি নিম্নরূপ:

عَنْ مَالِك عَنْ مُحَمَّدِ بْنِ يُوسُفَ عَنْ السَّائِبِ بْنِ يَزِيدَ أَنَّهُ قَالَ أَمَرَ عُمَرُ بْنُ الْخَطَّابِ أُبَيَّ بْنَ كَعْبٍ وَتَمِيمًا الدَّارِيَّ أَنْ يَقُومَا لِلنَّاسِ بِإِحْدَى عَشْرَةَ رَكْعَةً.

হাদীসটি সাইব ইবনে ইয়াযীদ রা. থেকে তার দু’জন ছাত্র বর্ণনা করেছেন। (মুআত্তা মালেক হা. নং ১৩৫) (এক) মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ, (দুই) ইয়াযীদ ইবনে খুসাইফা। মুহাম্মাদ ইবনে ইউসুফ থেকে আবার তার পাঁচজন ছাত্র বর্ণনা করেছেন। যথা: ইমাম মালেক, ইমাম ইয়াহইয়া ইবনে সাঈদ আল-কত্তান, আব্দুল আযীয ইবনে মুহাম্মাদ, ইবনে ইসহাক, আব্দুর রাযযাক। তবে এ পাঁচজনের বর্ণনা পাঁচ রকম। যাকে পরিভাষায় ‘ইযতিরাব’ বলা হয়। তাদের কেউ এগারো রাকা‘আতের কথা, কেউ তেরো রাকা‘আতের কথা, আবার কেউ একুশ রাকা‘আতের কথা বর্ণনা করেছেন। 

অপরদিকে, সাইব ইবনে ইয়াযীদ রা.-এর অপর ছাত্র ইয়াযীদ ইবনে খুসাইফা থেকে এ হাদীসটি ইবনু আবী যিব ও মুহাম্মাদ ইবনে জাফর বর্ণনা করেছেন। আর তারা দু’জনই বিশ রাকা‘আতের কথা বর্ণনা করেছেন। বিশ রাকা‘আত সম্বলিত তাদের রিওয়ায়াতটি নিম্নরূপ:

ابْنُ أَبِي ذِئْبٍ، عَنْ يَزِيدَ بْنِ خُصَيْفَةَ، عَنِ السَّائِبِ بْنِ يَزِيدَ قَالَ: " كَانُوا يَقُومُونَ عَلَى عَهْدِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ رَضِيَ اللهُ عَنْهُ فِي شَهْرِ رَمَضَانَ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً " 
مُحَمَّدُ بْنُ جَعْفَرٍ قَالَ: حَدَّثَنِي يَزِيدُ بْنُ خُصَيْفَةَ، عَنِ السَّائِبِ بْنِ يَزِيدَ قَالَ:  «كُنَّا نَقُومُ فِي زَمَانِ عُمَرَ بْنِ الْخَطَّابِ بِعِشْرِينَ رَكْعَةً وَالْوِتْرِ»

অর্থ: সাইব ইবনে ইয়াযীদ রা. বলেন, আমরা উমর রা.-এর যুগে বিশ রাকা‘আত তারাবীহ পড়তাম এবং আলাদাভাবে বিতর পড়তাম। (সুনানে বাইহাকী কুবরা হা. নং ৪৩৯৩, মা’রেফাতুস সুনান হা. নং ১৪৪৩)

ইবনে আবী যিব রহ.-এর রিওয়ায়াতটিকে ইমাম নববী, ইরাকী, সুয়ূতীসহ আরো অনেকে সহীহ বলেছেন। (তুহফাতুল আখইয়ার: পৃ. ১৯২, ইরাশাদুস সারী: ৩/২৩৪, তুহফাতুল আহওয়াযী: ২/৭৫)

আর মুহাম্মাদ ইবনে জাফরের রিওয়ায়াতকে মোল্লা আলী ক্বারী রহ.শরহে মুআত্তাতে সহীহ বলেছেন (তুহফাতুল আহওয়াযী: ২/৭৫)

সুতরাং দেখা গেলো, ইয়াযীদ ইবনে খুসাইফার দুই ছাত্র একই শব্দে হযরত সাইব ইবনে ইয়াযীদ রা.-এর সূত্রে বিশ রাকা‘আতের কথা উল্লেখ করেছেন। অপরদিকে, মুহাম্মাদ বিন ইউসুফের পাঁচজন ছাত্র পাঁচ ধরনের রিওয়ায়াত করেছেন, যেগুলো উসূলে হাদীসের দৃষ্টিতে ‘মুযতারাব’ বলে গন্য হয়। আর মুযতারাব হাদীস কোনো ইমামের মতেই দলীলযোগ্য নয়। উপরন্তু, হাদীসটি সহীহ হলে স্বয়ং উবাই ইবনে কা’ব রা. ২০ রাকা‘আত না পড়িয়ে ৮ রাকা‘আত পড়াতেন।

(৪) একজন রাবী উমর রা.-এর যুগের তারাবীহের বর্ণনা দিতে গিয়ে ২০ এর স্থলে ভুলক্রমে ৮ বলে ফেলেছেন। আর এটিকেই লা-মাযহাবী বন্ধুগণ সানন্দে লুফে নিলেন। অথচ,

(ক) পূর্বোল্লিখিত বিপুল পরিমাণ সহীহ বর্ণনার মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত ইজমা ও ধারাবাহিক কর্মধারার আলোকে উমর রা.-এর যুগে এবং পরবর্তী খুলাফাদের যুগে তারাবীহের নামায ২০ রাকা‘আত হওয়াটা সুপ্রমাণিত। এতে বিন্দুমাত্র সন্দেহের অবকাশ নেই।

(খ) ইমাম ইবনে আব্দুল বার রহ. ও আরো বেশকিছু মুহাক্কিক আলিম বলেছেন যে, ২০ এর স্থলে ৮ উল্লেখ করা বর্ণনাকারীর ভুল। (দেখুন: আল ইসতিযকার: ৫/১৫৬; রাকা‘আতে তারাবীহ: পৃ. ১১-১২)

শেষকথা: “একটি সহীহ হাদীসের অপব্যাখ্যা, দু’টি পরিত্যক্ত ও একটি বিভ্রান্ত বর্ণনা”-গোঁজামিল মার্কা এতোটুকুন পুঁজি নিয়ে বিপুল পরিমাণ নির্ভরযোগ্য ও অকাট্য বর্ণনার মাধ্যমে সাহাবায়ে কিরাম থেকে শুরু করে পরবর্তী সমস্ত যুগের ইমামগণের ঐক্যমত্যে প্রতিষ্ঠিত অবিচ্ছিন্ন কর্মধারার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করা খেলনার পিস্তল নিয়ে বাঘ শিকারে বেরিয়ে পড়ার নামান্তর। সুস্থ-মস্তিষ্কসম্পন্ন কোনোলোক এটি কখনো কল্পনাও করতে পারেন না। তাই লা-মাযহাবী ভাইদের প্রতি উদাত্ত আহবান জানাচ্ছি, মুসলিম উম্মাহর এ দুর্দশার যুগে অনৈতিক পন্থায় অপপ্রচার ও প্রোপাগান্ডার বিষবাষ্প ছড়িয়ে সরলমনা মুসলমানদেরকে আর বিভ্রান্ত না করে শাশ্বত সত্যের ছায়াতলে আশ্রয় গ্রহণ করুন।

আল্লাহ তা‘আলা আমাদের সকলকে বাস্তব সত্য গ্রহণ করার ও তদনুযায়ী আমল করার তাওফীক দান করুন। আমীন।

https://play.google.com/store/apps/details?id=com.islami_jindegi
Share This